ঢাকাSaturday , 22 August 2020
  • অন্যান্য

করোনাভাইরাস সুস্থতার হারে পিছিয়ে বাংলাদেশ

news
August 22, 2020 10:57 am । ৮১ জন
Link Copied!

অনলাইন ডেস্ক : বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ১৫টি দেশের সঙ্গে পালস্না দিয়ে করোনায় আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা হুহু করে বাড়লেও সুস্থতার হারে বাংলাদেশ এখনো অনেক বেশি পিছিয়ে রয়েছে। পাশাপাশি দেশে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যাও দ্রম্নত উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ফলে মরণব্যাধি করোনায় মৃতের হারও আগামীতে আরও বেশখানিকটা বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জোরালো আশঙ্কা করছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত, করোনা প্রতিরোধে সরকারের দুর্বল প্রস্তুতি এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের চরম উদাসীনতা দেশকে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি করোনা আক্রান্ত রোগীদের অনেক বেশি ভোগাচ্ছে। দেশে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে শুরু থেকেইর্ যান্ডম টেস্ট এবং শনাক্ত রোগীদের হোম কোয়ারেন্টিনে কিংবা হাসপাতালে আইসোলেশনে রেখে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে সুস্থতার হার আরও অনেক বাড়ত বলে মনে করেন তারা।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা এবং সুস্থতার হার ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের দেওয়া আপডেট তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার (২১ আগস্ট) পর্যন্ত আমেরিকায় করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৭২ জন। এ দিন পর্যন্ত দেশটিতে সুস্থ হয়েছেন ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৪ জন। অর্থাৎ দেশটিতে সুস্থতার হার ৫৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ব্রাজিলে মোট আক্রান্ত ৩৫ লাখ ৫ হাজার ৯৭ জন; সুস্থ হয়েছেন ২৬ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৭ জন; সুস্থতার হার ৭৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ভারতে মোট আক্রান্ত ২৯ লাখ ৫ হাজার ৮২৩ জনের মধ্যে সুস্থ হয়েছে ২১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৪৬ জন। সুস্থতার হার ৭৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। রাশিয়ায় মোট আক্রান্ত ৯ লাখ ৪২ হাজার ১০৬ জনের মধ্যে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৩ জন সুস্থ হওয়ায় সুস্থতার হার দাঁড়িয়েছে ৮০ দশমিক ১৯ শতাংশে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৯৪০ জন; সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৯৭ হাজার ১৬৯ জন। সুস্থতার হার ৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পেরুতে মোট আক্রান্ত ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯ জন; সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৮০ হাজার ৭৩০ জন। সুস্থতার হার ৬৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। মেক্সিকোতে মোট আক্রান্ত ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৬ জনের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৩৮ জন। এ হিসেবে সুস্থতার হার ৬৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

এছাড়া করোনার বিশ্বতালিকার টপ ফিফটিনে থাকা কলোম্বিয়ায় সুস্থতার হার ৬৬ দশমিক ০১ শতাংশ; চিলিতে ৯৩ দশমিক ৪১ শতাংশ, ইরানে ৮৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, আর্জেন্টিনায় ৭২ দশমিক ৮১ শতাংশ, সৌদি আরবে ৯০ দশমিক ৬২ শতাংশ, পাকিস্তানে ৯৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও বাংলাদেশে ৫৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের এ পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের বিশ্বতালিকার ১ নম্বরে থাকা আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০ গুণ কম হলেও সুস্থতার হারে তাদের কাছাকাছি। তবে টপ ফিফটিনে থাকা অন্য ১৪টি দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সুস্থতার হার বিশাল ফারাক রয়েছে। চিলি, ইরান, আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ যেসব দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশের প্রায় সমসংখ্যক, ওইসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সুস্থতার হার ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কম।

এদিকে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো বিশ্বতালিকার ১৬ নম্বরে থাকলেও দেশটিতে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা এ তালিকার উপরের দিকে থাকা আরও ৭টি দেশের চেয়ে বেশি, যা ওয়ার্ল্ডোমিটারের আপডেট তথ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ওয়েবসাইটে দেওয়া ২১ আগস্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকায় বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬৪ জন। এছাড়া ব্রাজিলে ৭ লাখ ৩৯ হাজার ২৬৭ জন, ভারতে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৯০২ জন, রাশিয়ায় ১ লাখ ৭০ হাজার ৪৯৪ জন, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯০ হাজার ১৫৩ জন, পেরুতে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৯৫ জন, মেক্সিকোতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৬২ জন, কলোম্বিয়ায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪১২ জন, চিলিতে ১৫ হাজার ১১৫ জন, ইরানে ২৮ হাজার ৫৮ জন, আর্জেন্টিনায় ৮০ হাজার ৭১৬ জন, সৌদিতে ২৪ হাজার ৯৪৯ জন, পাকিস্তানে ১১ হাজার ৭৯০ জন এবং বাংলাদেশে ১ লাখ ১৫ হাজার ১৪৬ জন। এ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, চিলি, ইরান, আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব ও পাকিস্তান- এই সাতটি দেশে করোনার একটিভ কেস (চিকিৎসাধীন রোগী) বাংলাদেশের চেয়ে কম।

দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ওয়ার্ল্ডোমিটারের দেওয়া উপরের পরিসংখ্যানে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বল চিত্র উঠে এসেছে। চিকিৎসাব্যবস্থা আরও উন্নত করা গেলে চিকিৎসাধীন রোগীরা আরও দ্রম্নত সুস্থ হয়ে উঠত বলে মনে করেন তারা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে করোনার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর থেকেই চিকিৎসাব্যবস্থার নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে বিপুলসংখ্যক রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যাদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থেকে মারা যাচ্ছে। এ ধরনের গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে দাবি করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দেশের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর ৭০ শতাংশ শয্যা খালি পড়ে আছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও এতে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ রয়েছে।

করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোভিড হাসপাতালের সাধারণ শয্যা খালি থাকলেও আইসিইউ ও সিসিইউ কেবিন বা বেড একটিও খালি নেই। বিশেষ করে বেসরকারি কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও সিসিইউ বেডে ভর্তি হওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক গুরুতর অসুস্থ রোগী সিরিয়াল দিয়ে আছেন।

কোভিড হাসপাতালের সাধারণ শয্যা ফাঁকা থাকা এবং আইসিইউ ও সিসিইউ বেডে দীর্ঘ সিরিয়াল থাকার রহস্য সম্পর্কে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা ও দুর্ভোগের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। এ কারণে জ্বর-কাশি বা গলাব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ে করোনা রোগীরা কেউ সহজেই হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। তারা নানাভাবে চিকিৎসা সহযোগিতা নিয়ে বাসায় আইসোলেশনে থাকছে। তবে শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় অনেককে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনা ও হয়রানির কারণে গুরুতর অসুস্থ অনেক রোগী অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে এনে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান তারা।

বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী সূত্রগুলো বলছে, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে শুরু থেকেই সুস্থতার হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর ৬০ দিনের মাথায় সুস্থতার হার ছিল ২৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা কিনা ওই সময়ে করোনায় বহির্বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইতালির অর্ধেকেরও কম! ইতালিতে করোনা আক্রান্ত প্রথম ৬০ দিনে সুস্থতার হার ছিল ৫৫ দশমিক ৭৫। অন্যদেশগুলোতে একই সময়ে সুস্থতার হার ছিল ইতালির চেয়েও বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলোজি বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, সুস্থতার হার না বাড়ার জন্য শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করলে হবে না। এ পেছনের আনুষাঙ্গিক কারণগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে। তার ভাষ্য, দেশে করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার মাস তিনেক পর সুস্থতার হার কিছুটা বাড়তে শুরু করলেও সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতা এবং এ ব্যাপারে সরকারের উদাসীনতা তা ফের ‘ইউটার্ন’ করেছে।

বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসকের অভিযোগ, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী হলেও তা প্রতিরোধে নতুন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তো নেওয়াই হয়নি বরং আগে নেওয়া কৌশলগুলো একে একে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পরীক্ষা, শনাক্ত, আক্রান্তের উৎস বের করা এবং আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা- এই চার মূল কৌশলের মধ্যে পরীক্ষার হার এখন আগের চেয়ে আরও সীমিত করা হয়েছে, আবার যতটুকু পরীক্ষা হচ্ছে তার ভিত্তিতে যারা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই আইসোলেশনের বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিরোধের আরেক অপরিহার্য বিষয় হিসেবে আক্রান্ত হওয়ার উৎস খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে সার্বিক দুর্বলতা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। হাসপাতালগুলোর অবস্থা মাঝখানে কিছুটা উন্নত হলেও হাসপাতালমুখী পজিটিভ রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কমই থেকে যাচ্ছে। জটিলতা নিয়েও অনেকেই বাসাবাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। নানা ডামাডোলের আড়ালে লকডাউন, রেড জোন, কোয়ারেন্টিন কিংবা আইসোলেশন প্রক্রিয়াগুলো চাপা পড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি-সামাজিক দূরত্ব মানার কথা বলা হলেও বাস্তবে এগুলোও এখন আর কার্যকর নেই। অফিস-আদালত, সরকারি বেসরকারি সব আর্থ-সামাজিককার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে। অথচ স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। এমনকি পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েও উপসর্গহীন আক্রান্তরা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ্যেই চলাফেরা করছে। তাদের আইসোলেশনে নেওয়ারও এখন আর কোনো ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না। বিদেশ থেকে মানুষ আসার সংখ্যাও বেড়েছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা যতই উন্নত করা হোক না কেন, সুস্থতার হারে নতুন গতি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এ পরিস্থিতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেন। তার ভাষ্য, দেশে করোনা সংক্রমণের হার বাড়লেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে চিত্র তুলে না ধরে বরং কৌশলে ভিন্ন তথ্য সামনে তুলে ধরছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা আরও কমছে, যা সুস্থতার হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।